আবোল তাবোল

6 minute read

ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর কালজয়ী লেখা। প্রতিটি শব্দের সাথে যেন জড়িয়ে আছে আবেগ। দেশাত্নবোধক গান হিসাবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি আবশ্যকীয় উপাদান হয়ে আছে এবং থাকবে। যেকোন জাতীয় উৎসবের সাথেই খুব সুন্দর মানিয়ে যায়। হোক সেটা পহেলা ফাল্গুন কিম্বা বৈশাখ অথাবা ষোলই ডিসেম্বর। দেশের অগণিত টেলিভিশন চ্যানেলের কল্যাণে এরকম যেকোন জাতীয় উৎসবে এই গান কিম্বা এই ধরণের গানগুলো বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরে প্রত্যেক বছর দেশের তরুণ প্রজান্মের চিত্রকর্মীরা। বিষয়টা একিসাথে প্রশংসনীয় এবং অদ্ভুতভাবে উদ্বেগেরও। দেশপ্রেমের নামে আমরা বিষাক্ত স্বদেশপ্রেম শেখাচ্ছি না তো? নিজেদের এবং অন্যদেরকে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছি না তো? কয়েকটা প্রজন্ম পার হয়ে যাওয়ার পরে এই গানের লাইনগুলোর কি আদৌ কোন মানে থাকবে?

আমাদের প্রজন্মের কথাই বলি। ছোটবেলাথেকেই আমরা বড় হয়েছি আইনের শাসন নেই এমন একটা দেশে। যেখানে ঘুষ দেয়া ছাড়া কোন সরকারী কাজ করা যায় না। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চাকুরীজীবী তার পেনশনের টাকাটা পর্যন্ত নিতে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ভাতা পায় না। দিনে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে গুলি আর চাপাতির কোপ। বাজারে ভেজাল ছাড়া খাবার পাওয়া না। পুলিশ যেখানে জনগণের শত্রু। উন্নয়নের নামে যেখানে চলে দেশটাকে লুটপাট করে ফেলা। বাকস্বাধীনতা যেখানে বাকরুদ্ধ। সেই দেশটি কিভাবে সকল দেশের সেরা হয়? কবিতা আর গানের আবেগ কি আমাদের কিম্বা পরের প্রজন্মকে দেশকে ভালবাসতে শেখাবে নাকি ঘৃণা করতে শেখাবে? এখন এধরণের প্রশ্ন করা মানে যেন কোন ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরুকে অসম্মান করা। এই স্পর্ধাকে কখনো টিকতে দেয়া হয় না। আর হয় না বলেই মুজিব বর্ষের মত পঞ্জিকার আত্নপ্রকাশ ঘটে।

দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটা কতটা নিচে গেলে শুধুমাত্র পাকিস্তানের নাম মুখে নিলে মুখ ধুয়ে আসতে হয়। কতটা নিচে গেলে অতীত ইতিহাসের জন্য একটা দেশের প্রতিটা মানুষকে ঘৃণা করতে শেখানো হয়, যে মানুষগুলোর সেই অতীত ইতিহাসের সাথে কোন সম্পর্কই ছিল না। অথচ দেশে সেই অতীতের পাকিস্তানীদের মতই ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামে গুলি চালনো হয়। হেলমেট বাহিনী নামানো হয়। আমাদের পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা হয়। কিন্তু পাকিস্তানীদের গোলা বারুদ দিয়ে যারা সাহায্য করলো তাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটা করার সাহস হয়না। যাদের ক্ষমতা ছিল পাকিস্তানের টুটি চেপে ধরার। কিন্তু তাদের মনে হয়েছিল এখানকার মুর্খদের গণহত্যা হলেই কি আর না হলেই কি। হাস্যকরভাবে আমরা তাদের কাছেই এসে বসে আছি। সেখানকার নাগরিকদের আমরা ঘৃণা করি না। শুধু পাকিস্তানী নামধারীদেরই ঘৃণা করি।

গোঁড়া দেশপ্রেমটা লক্ষ্য করা যায় বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও। যেখানে গর্ব করা উচিত ছিল ভাষার ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামের জন্য, সেখানে পুরো গর্বটাই গিয়ে পড়ে বাংলা ভাষার উপর। এখানে ভাষা হিসাবে বাংলার আলাদা কোন কৃতিত্ব নেই। বাংলা ছাড়া আমরা যদি বার্মিজ কিম্বা রাশান অথবা সোওয়াহিলি ভাষায় বলতাম তাহলে কি ভাষার ন্যায্য দাবির জন্য সংগ্রাম হতো না? সে ভাষাগুলো কি আমাদের মায়ের ভাষা হতো না? জাতী হিসাবে বাংলা আমাদেরকে অন্যান্যদের থাকে আলাদা করে। ভাষার জন্য আমাদের নিজস্ব অক্ষর আছে। টার্কিশদের মত ল্যাটিন অক্ষর ধার করতে হয় না। আর আছে ঈর্ষনীয় রকমের বাংলা ভাষার সাহিত্যসম্ভার। সেটা নিয়ে গর্ব করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই গর্বটা যখন গোঁড়ামির পর্যায়ে চলে যায় তখন কিছু অপ্রয়োজনীয় সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। যা কিনা আমাদের স্বাভাবিক উন্নতির ব্যাঘাত ঘটায়। ল্যাটিন কিবোর্ড ব্যাবহার করে যখন বাংলা লেখাটা সবার কাছে সহজলভ্য সেখানে নাকি বাংলা কিবোর্ডে বাংলা না লিখলে ভাষা শহীদদের অসম্মান করা হয়। আর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা ভাষা শহীদদের সম্মানে দোকানপাটের নাম ইংরাজিতে লেখা যাবে না বলে ফতোয়াও দিচ্ছেন। অথচ রাজউক এর লোগো তে এখনো উর্দু শোভা পাচ্ছে। কি হাস্যকর! কিছু বুদ্ধিজীবীরা তো আরেক ধাপ এগিয়ে। মায়ের ভাষা বাংলায়ে তারা সর্বস্ততরে উচ্চশিক্ষা পরিচালনা করতে চান। ফলাফল অতিমাত্রায় উদ্ভট শব্দগুচ্ছের সমারহ। অম্লযান, উদযান, সংকটকালিন কোণ এগুলো নাহয় বাদ দিলাম। প্রবাহ চিত্র (flow chart), কাঠামোমুখী সি/সি++ (structured C/C++), পরিগণনা (programing), হয়মান মন্ত্রপাতি (online software), নয়মান মন্ত্রপাতি (offline software), আদেশ প্রান্তিকা (command terminal), ছদ্মসংকেত (pseudocode), ফাকা ও ছাড়ন (spacing and indentation), একিক অনুক্রিয়া (unary operator), দুইক অনুক্রিয়া (binary operator), শর্তালি পরিগণনা (conditional programing) … এইসব কি 1? এই বিজ্ঞান যদি বাংলাভাষী কেউ আবিষ্কার করে এইসব নাম দিত সবাই মাথা পেতে নিত। কিন্তু পৃথীবিয় গ্রামে (!) এসবের কি কোন মানে হয়? জাতীর উন্নতির চাইতে ক্ষতিটাই তারা বেশী করে যাচ্ছেন। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে বাংলা ভাষা এমনটা ছিল না। কয়েকশ বছর পরেও আজকের মত থাকবে না। ভাষা তার নিজের গতিতেই চলে অন্য একটা ভাষা হয়ে যাবে। বুদ্ধিজীবীরা কি সেটা ঠেকাতে পারবেন?

অনেক অভিযোগ তো হলো। কিছু সমাধান আলচনা করা যাক। অন্য কোন দেশকে না দেখেই আমার জন্মভূমিকে সকল দেশের রাণী ঘোষণা দেয়াটা হয়তো আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু একিসাথে নির্বুদ্ধিতাও। আমাদের নেতাব্যক্তিরা আহরহই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে বিভিন্ন দেশকে টেনে আনেন। দেশকে আগামি পাঁচ বছরের মধ্যে সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলব। কেন ভাই? সকল দেশের রাণীকে সিঙ্গাপুর বানাতে হবে কেন? পুরনো বাংলাদেশ থেকে নতুন বাংলাদেশ বানানো যায় না? ১৯৬০ এর দশকে সারা পৃথীবিতে অকালে শিশু মৃত্যুর জন্য দায়ী ডায়রিয়ার জন্য WHO যখন হন্য হয়ে সমাধান খুঁজতেছিল, বঙ্গালীদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকেই স্বল্পখরচের সমাধান খাওয়ার স্যালাইন তৈরি হয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানই আজ ICDDRB নামে পরিচিত 2। কই সিঙ্গাপুরের তো দরকার হয় নি। এই খাওয়ার স্যালাইনের জন্যই আজ ডায়রিয়াকে কেউ গোনায় ধরে না। গুরুত্বপুর্ণ সমস্যার আনকোরা সমাধানের জন্য কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড আর ডাইভার্সিটি কাজে লাগে। এমআইটি, বার্কলে এমনি এমনি সোমালিয়া থেকে ছাত্র ছাত্রী নেয় না। ইউনিসেফ এ ফান্ডিং এ বাংলাদেশ পুরো দেশব্যাপী যে প্রচারণা আর ভ্যাক্সিনেশন চালিয়েছে, তাতে দেশ থেকে পোলিও দূর হয়ে গেছে। দেশে আর মিজেলস এর রোগী পাওয়া যায় না। আমেরিকাতে কিন্তু পাওয়া যায়। দেশের মানুষ অশিক্ষিত, মুর্খ্য, মিথ্যুক, ধকাবাজ, ছোটলোক, গরীব হলেও মিনা কার্টুনের দেয়া উপদেশ ঘিলুতে ঢুকাতে পারে। তাই দেশের সমস্যা সমাধানে দেশের কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডকেই ব্যবহার করতে হবে। সিঙ্গাপুরের না।

রাস্তাঘাটে দেয়ালের ধারে পস্রাব করা দেশের মানুষের পুরানো অভ্যাস। এটাকে সমাধানের একটা চমৎকার উপায় আছে। কিছু জায়গায় কাজেও দিচ্ছে। দেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। অদ্ভুত রকমের ধর্মভীরু তারা। ঘুষ খাইতে, খাবারে ভ্যাজাল দিতে সমস্যা নাই তাদের। কিন্তু আরবি লেখা মাটিতে দেখলে জিহাদ ঘোষণা করবে। এই সুযোগটা ব্যাবহার করে দেয়ালে আবোল তাবোলও আরবিতে লিখে দিয়ে মানুষকে রাস্তার ধারে প্রসাব করা থেকে বিরত রাখা যাবে। বাংলাদেশ মিনিস্টারি অফ রিলিজিয়াস আফেয়ার্স 3 এই ইউনিক আইডিয়া বের করে কাজে লাগাচ্ছে। সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। কিন্তু আমার মতে দেশের উন্নয়নের পথে মুল অন্তরায় টাকা লোপাট। এর সমাধান আমার জানা নেই। পাঠকের কাছ থেকে আনকোরা সমাধান আশা করছি। দেশের কাঠামোগত দিকে একটু নজর দেয়া যাক। দেশের পরিবহন সেক্টর এখনো সেকেলে। দেশের একপ্রান্ত থেকে অ্ন্য প্রান্তে যেতে রাজধানী ঢাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ঢাকার ট্র্যাফিক জ্যামের অন্যতম কারণ এটা। কর্তাব্যক্তিরা ঢাকার পরিবহন ব্যাবস্থাকে ইউরোপ আমেরিকার মত করতে চান। ঠিকআছে। ইউরোপ আমারিকা তাহলে দেখে আসা যাক।

pypass-world

ওপেনস্ট্রিট ম্যাপ থেকে নেয়া উপরের ছবিগুলো বিখ্যত সব শহরের। কোন প্যাটার্ন চোখে পড়ে কি? প্রত্যেক শহরের সিটি সেন্টারগুলোকে ঘিরে বৃত্তাকারে অন্তুত একটি বাইপাস রাস্তা আছে। এগুলো দিয়ে শহরের ভিতরে না ঢুকে শহর বাইপাস করে চলে যাওয়া যায়। শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে হলে শহরের মধ্যে ভিড় না করে উচ্চগতির বাইপাস সড়কগুলো ব্যাবহার করা যায়।

এবার দেশে আসা যাক। নিচে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় কোন বাইপাস নেই। যেখানে থাকাটা সবচেয়ে দরকার ছিল। তাতে শুধু ঢাকার জ্যামই লাঘব হত না, বরং ঢাকার উপর চাপও কমত। সেটা না করে উড়াল সেতুর পেছনে অহেতুক টাকা ঢালা হচ্ছে। আচ্ছা বলুন তো পৃথিবীর আর কোন দেশে উড়াল সেতুর উপর ট্রাফিক সিগনাল আছে? উড়াল সেতু দিয়ে কোন লাভটা হল তাহলে?

bypass-bd

বগুড়াকে কেউ ইউরোপ আমেরিকা বানাতে চায় নাই। অথচ বগুড়ার চারপাশে অন্যান্য উন্নত শহরের মত বৃত্তাকার বাইপাস দেখা যাচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রকৌশলী নিয়ে এসে এই ডিজাইন করা লাগে নি। এই দেশের কর্তাব্যাক্তিরাই এইটা করতে পেরেছে। তাহলে ঢাকার অবস্থা এমন আজও এমন কেন? চট্টগ্রামে কিছুটা বৃত্তাকার বাইপাস দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রামে যদি হতে পারে ঢাকা আজও পিছিয়ে আছে কেন? একটি মেগাসিটির স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করা হচ্ছে ঢাকাকে। নাগরিক হিসাবে আমাদের যে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার আরে নিয়ম না মানার যে অভাব আছে তা যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করে নেয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি তার সমাধানও বের হয়ে যাবে। নিচের ছবিগুলো ইটালির ফ্লোরেন্স আর ভেনিস এ তোলা। আমাদের দেশের সব পাড়ার মতই চিপা রাস্তা, ঘিঞ্জি, চাপাচাপি করে লাগানো বাড়ি ঘর। ক্যানালগুলো আমাদের বাসার পাশের বড়সড় ড্রেনের মত।

italy

কিন্তু এই অলি গলি গুলোতে হাঁটলে নর্দমার গন্ধ পাওয়া যায় না। তিনতলা থেকে কেউ নিচে তরকারির খোসা ফেলে না। গলিতে থুতু ফেলে না। এই ঘিঞ্জি জায়গাগুলো বসবাসের যোগ্য হলে ঢাকার এবং দেশের অলি গলি হবে না কেন? তাই বাধ্য হয়ে আবোল তাবোল এর মত বলতে হয় যে লাঠি ছাড়া বাঙালি সোজা হবে না।


  1. https://www.rokomari.com/book/180900/structured-c-c-programming–kathamomukhi-c-c-plus-plus-porigonona?ref=fl12_p0&fbclid=IwAR3YPruzghDICrGZn5Z0_y9JAoMLGyo6v1IhrPdVdU58Jd8Dc9wpv7xrr_g 

  2. https://www.icddrb.org/about-us/achievements 

  3. https://www.youtube.com/watch?v=1vQIRvfhqGk 

Categories:

Updated: