ইতিহাসের এক টুকরো

3 minute read

১৯৩৯ সাল। গোটা বিশ্ব তখন ধ্বংসের মাতাল খেলায় উন্মত্ত। জার্মানির আক্সিস ফোর্স তখন অপ্রতিরোদ্ধ শক্তির মত খেলার মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর্টিলারি শক্তি তো আছেই। জার্মানির ছিল আর একটা বড় শক্তি। মাথা নষ্ট রকমের ব্রিলিয়ান্ট বিজ্ঞানীর দল। যেসব বিজ্ঞানীর হাত ধরে পরমাণু তার লুকানো রহস্য মানুষের সামনে তুলে ধরেছে তার মোটামুটি সবাই একি সময়ে তাদের আবিস্কার নিয়ে হাজির ছিল জার্মানি আর তার আশে পাশের দেশগুলোতে। থিওরিটিকালি তখন সবাই পারমাণবিক বোমার সম্ভবনার কথা জানত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যুদ্ধ যেসব পলিটিকাল লিডাররা পরিচালনা করত তারাও পারমাণবিক বোমার ভয়াবহ ক্ষমতার কথা জানত। একারণেই মিত্র শক্তির ভয় ছিল যে জার্মানি হয়ত গোপনে পারমাণবিক বোমা বানায়ে ফেলেছে। কিন্তু মিত্র শক্তির বসে বসে ঘাস কাটা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। জিনিসটা আর একটা মাথা নষ্ট বিজ্ঞনীর পছন্দ হল না। হাঙ্গেরি বংশদ্ধভুত বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড তখন কলম্বিয়া উনিভার্সিটিতে নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিশন নিয়ে গবেষণা করত। সে দেখল যে নিউক্লিয়ার চেইন রিএকশন দিয়ে বিশাল পরিমাণে শক্তি বের করা যাবে যা দিয়ে অসম্ভব শক্তির বোমা বানানো সম্ভব। যেই ভাবা সেই কাজ। ২ অগাস্ট ১৯৩৯। স্বয়ং আইন্সটাইনকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি দিল। ভাইসাব! গার্মানি তো ফাটায়ে ফেলতেসে। আর আপ্নে কি ছিড়তেছেন। আমার কাছে ফর্মুলা আছে। রুজভেল্ট বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে বিষয়টাকে সিরিয়ালি নিল। আমাদের দেশের সরকারের মত গণ্য মান্য ব্যাক্তি বর্গের প্রোপোজাল ইগ্নোর করে জ্বালানি ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের আইডিয়াকে বাহবা দেয়ার মত লোক রুজভেল্ট না। রুজভেল্ট কাজের কাজটাই করল। মানহাটন প্রজেক্টকে আপ্রুভাল দিয়ে দিল টপ সেক্রেট প্রজেক্ট হিসাবে। শত্রু শক্তি যেন না জানে যে আমেরিকা পারমাণবিক শক্তি নিয়ে কাজ করছে এ জন্য প্রজেক্টটা টপ সিক্রেট করার দরকার ছিল জিনিস্টা এতটাই সিক্রেট ছিল যে ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান টেরই পায় নি যে তার নাকের ডগায় এত বিশাল কিছু হচ্ছে। গোটা আমেরিকার ত্রিশটা সাইটে প্রজেক্ট এর কাজ শুরু হল। কিন্তু ইনফ্রাস্ট্রাকচার ছিল তিন জায়গায়। ওয়াশিংটনের হানফোর্ড, নিউমেক্সিকোর লস আল্মোস এবং টেনেসির ওক রিজ। নিউক্লিয়ার বোমার জন্য প্রয়োজন প্রচুর প্ররিমাণে প্লুটোনিয়াম যেটা মাত্র কিছুদিন আগেই আবিস্কার হয়েছিল। সেটা বানানোর জন্য আবার প্রয়োজন ইউরেনিয়েম-২৩৮ এর নিয়ন্ত্রিত নিউট্রন এর চেইন রিএকশন। কেউ তখনও এটা করার সাহস ও দেখায় নি। কিন্তু লিও জিলার্ড আর ফার্মির ফরমুলা দিয়ে ওপেনহাইমার এই অসম্ভব কাজ করার উদ্যোগ নিল। প্লুটোনিয়াম তৈরির পুরা কাজটাই হয়েছিল টেনেসির ওক রিজ এ। ইউরেনিয়েম-২৩৮ এর নিয়ন্ত্রিত নিউট্রন এর চেইন রিএকশন এর জন্য দরকার ছিল গ্রাফাইট রিএক্টর যা কিনা অতিরিক্ত নিউট্রন কে নিয়ন্ত্রণ করবে। আজ গিয়েছিলাম সেই গ্রাফাইট রিএক্টরে। X-10 Graphite Reactor at Oak Ridge. খুবই সাধারণ দেখতে একটা টিনেট স্ট্রাকচার

Graphite reactor.

উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেইন রিএক্টরটা। কিছু লাইফ সাইজ পুতুল ও রাখা আছে। গোল গোল জিনিসগুলো দিয়ে ইউরেনিয়াম এর রড ঢুকানো হয়। ভিতরে আছে গ্রাফাইট ইয়া বড় দেয়াল। ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর সাথে নিউট্রন এর সংঘর্শে তৈরি হয় প্লুটোনিয়াম-২৩৯। অতিরিক্ত নিউট্রন শোষণ করে নেয় ভিতরে থাকা গ্রাফাইট। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে কন্ট্রোল রুম।

কোন রকম ডিজিটাল কম্পিউটার ছাড়া শুধুমাত্র আনালগ মেজারিং ডিভাইস দিয়ে তারা পুরো কাজটা সম্ভব করেছিল। ভাবলেই অবাক লাগে। নিচের চবিতে কিছু মেজারিং ডিভাইস দেখা যাচ্ছে। আনালগ গ্রাফ প্লটিং ডিভাইস সবগুলো। অনেকটা ভুমিকম্প মাপার সিস্মোগ্রাফের মত।

ভিতরে একটা ইন্টারেস্টিং পেরিওডিক টেবিল ছিল। একটা শোকেস এর সমান স্ট্রাকচার। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকটা ব্লক এ একটা এলেমেন্ট আর তাদের প্রপার্টি। কিন্তু যে জিনিস্টা ইন্টারেস্টিং সেটা হল প্রত্যেকটা ব্লকে এলেমেন্টগুলোর একটু করে স্যাম্পল ও দেয়া।

রিএক্টরএর লোকেশন সিলেক্ট করা হয়েছিল দুইটা পাহাড়ের মাঝখানে জনশূন্য এলাকায়। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে জীবনের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। ১৯৩৯ সালে ওখানে কাজ করার জন্য মানুষের ইন্টারভিউ নেয়া হত অনেকটা এভাবে। তোমাকে আমরা সিলেক্ট করেছি। কিন্তু তুমি কাউকে বলতে পারবে না তুমি কি কাজ করছ। পরিবারকেউ না। আমরাও তোমাকে বলব না তোমাকে আমরা কই নিয়ে যাচ্ছি। কর্মচারিদের ফ্যামিলির সাথে ইন্টারেক্ট করা হত চিঠি দিয়ে। ইনকামিং এবং অউটগোইং সব চিঠি পাঠানোর আগে মনিটর করা হত। মানুষগুলো এতটাই আইসোলেটেড ছিল যে সাইকোলজিকাল প্রবলেম দেখা দিত। সাইকোলজিস্ট ডেকে এনে আবার চিকিৎসা করা লাগত।

এত মানুষের কষ্ট, কিছু ব্রিলিয়ান্ট মাথা আর কিছু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পলিটিশিয়ানদের যৌথ প্রচেস্টায় সম্ভব হয়েছিল এমন কিছু যা পৃথিবীর এখনকার ফরেন পলিসি আর সম্পর্ক সারা জীবনের জন্য পালটে দিয়েছে। এই রিএক্টরটার কারণেই সম্ভব হয়েছে নিউক্লিয়ার আর্মস রেস এর। আমরা আজ এমন বিশ্বে বাস করি যেখানে মানুষ চোখের পলকে গোটা বিশ্ব ধ্বংস করে দিতে পারে। পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা এখন মাদার রাশিয়া এর দখলে। TZAR Bomba. নিচের ছবিতে তার শক্তির এর আন্দজ পাওয়া যাবে।

আমি মোটামুটি এসব কিছুর শুরুর আতুর ঘর থেকে ঘুরে এলাম। বিশ্বাস করতেও একটু কষ্ট হচ্ছে। শত্রুর কাছে থেকে বাঁচতে মানুষ তার সাদ্ধের মদ্ধে কত কিছুই না করে। সামনে ১৬ ডিসেম্বর। পাক হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের মানুষ ঠিক একই রকমেই সবকিছু উজার করে দিয়েছিল।

Categories:

Updated: